সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৪৬ অপরাহ্ন
শায়খ ড. আহমাদ বিন আলি আল হুজাইফি:
হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে যে মিম্বারে খুতবা দিতেন, সেটা মিম্বারে নববি নামে প্রসিদ্ধ। এই মিম্বারে নববিই হলো- ইসলামের বার্তা বর্ণনার সূচনাস্থল, নবীর দাওয়াতের মিম্বার, হিজরতের সূচনা থেকে দুনিয়ার শেষ পর্যন্ত তার সূর্যোদয়স্থল। তার দিগন্ত থেকেই নববি বর্ণনার সূর্য উদিত হয়েছে, তার আস্তিন থেকে সুরভি ছড়িয়ে পড়েছে এবং তার উৎস থেকে ঝর্ণা প্রবাহিত হয়েছে। হজরত জিবরাইল (আ.) কর্র্তৃক সাহায্যপ্রাপ্ত কবির উক্তিটি কতই না সুন্দর! ‘তাইবা (পবিত্র) নগরীতে রয়েছে রাসুলের পদচিহ্ন ও উজ্জ্বল আবাসস্থল…, অনেক পদচিহ্নই পরিবর্তন ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়; তবে ওই পবিত্র ঘরের নিদর্শনসমূহ নিশ্চিহ্ন হয় না যেখানে রয়েছে নবীর মিম্বার, যাতে তিনি আরোহণ করতেন। তার পদচিহ্ন সুস্পষ্ট, নিদর্শনাবলি অক্ষত এবং এর আঙিনায় রয়েছে মুসাল্লা ও মসজিদ, এর নিদর্শনাবলি কালক্রমেও নিশ্চিহ্ন হয়নি…, এতে জীর্ণতা এলেও নিদর্শনগুলো নবায়িত হয়েছে।’
এখান থেকেই নবী মুস্তফা (সা.) খুতবা প্রদান করেছেন। তার অলংকারপূর্ণ খুতবার ফলে বিদগ্ধ ভাষাবিদরা বাকরুদ্ধ হয়েছেন, বিশুদ্ধভাষীদের নির্বাক করেছে এবং বাগ্মীরা স্তম্ভিত হয়েছেন। মহাকালের কর্ণসমূহ এমন বাকরীতি শ্রবণ করেছে যা প্রাঞ্জল বর্ণনাকে প্রকাশ করে, রহমতের তরঙ্গমালা প্রবাহিত করে, ন্যায়-ইনসাফের সুরভি ছড়িয়ে দেয়, সত্যবাদিতার দ্বারা সিক্ত করে, হৃদয়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং অন্তরের সুপ্ত ভাবাবেগকে উদ্দীপ্ত করে। তার কথামালাগুলো যেন বিক্ষিপ্ত মণিমুক্তা অথবা বৃষ্টিস্নাত উদ্যানের মতো অপরূপ সুন্দর।
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) খুতবার মিম্বারে ছিলেন একজন সুবক্তা। তিনি যখন এই মর্যাদাসম্পন্ন মিম্বারে আরোহণ করতেন তখন বুঝা যেত না যে মিম্বারটি কোনো খতিবকে ধারণ করে আছে, নাকি তাতে সুগন্ধি লাগানো আছে? তিনি তার এ মিম্বারে আরোহণ করতেন অতঃপর ঐশী প্রত্যাদেশের মেঘমালা তার ওপর বর্ষিত হতো; যা হৃদয়ে দৃঢ় বিশ্বাসের জাগরণ ঘটানোর পাশাপাশি অন্তরকে প্রবল আকর্ষণে পূর্ণ করত, চোখের জলধরকে উদ্দীপ্ত এবং হৃদয়ের অশ্রুকে বর্ষণ করাত।
নবী কারিম (সা.) এমন ভাষায় বক্তৃতা করতেন, যার মধ্যে আল্লাহতায়ালা মহব্বত প্রদান করেছেন। তার মধ্যে মহিমা, মাধুর্য, সুন্দরভাবে বুঝানো ও স্বল্প কথায় প্রকাশের সক্ষমতার সমাবেশ ঘটিয়েছেন; ফলে তা পুনারাবৃত্তি এবং শ্রোতাদের পুনরায় জিজ্ঞাসার প্রয়োজন হতো না। তার বক্তৃতায় কোনো শব্দ বাদ পড়ত না, বিষয়ের বিচ্যুতি ঘটত না, কথামালা শত্রুতা সৃষ্টি করত না এবং কোনো বক্তা তাকে লা-জওয়াব করতে পারত না। বরং দীর্ঘ বক্তব্য স্বল্প কথায় প্রকাশের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্বে অন্যদের ছাড়িয়ে যেতেন। তিনি প্রতিপক্ষের জ্ঞাত বিষয় দ্বারা প্রতিপক্ষকে নির্বাক করে দিতেন এবং সত্যের দ্বারা বিতর্ক করতেন। তিনি বক্তৃতায় প্রলোভনের আশ্রয় নিতেন না, ধূর্ততা ও প্রতারণামূলক শব্দ ব্যবহার করতেন না, প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে নিন্দা করতেন না, বিলম্ব কিংবা তাড়াহুড়ো করতেন না এবং আলোচনাকে দীর্ঘায়িত ও অতি সংক্ষিপ্ত করতেন না। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কথার চেয়ে অধিক উপকারী কথা, ন্যায়সঙ্গত ভাষা, ভারসাম্যপূর্ণ ছন্দ, সুন্দর মত, উদার আহ্বান, স্থানের সঙ্গে অধিক সংগতিপূর্ণ, সহজ উচ্চারণযোগ্য, বিশুদ্ধ অর্থ সংবলিত এবং বক্তৃতায় অধিক ভাব প্রকাশক কোনো কথা মানুষেরা কখনো শোনেনি।
নিশ্চয় মিম্বার হলো অশ্বপৃষ্ঠ সদৃশ, তাতে আরোহণ করা শোভনীয় ওই ব্যক্তির জন্য- যে হৃদয়কে আকৃষ্ট করতে পারে এবং বক্তৃতার রাশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। বক্তৃতার জন্য জ্ঞানের উপকরণ সংগ্রহ করে ও তীক্ষè বুদ্ধিসম্পন্ন হয় এবং কথা ও কাজে একনিষ্ঠতার বর্মে সজ্জিত হয়। এই মিম্বার হলো আল্লাহ ও তার রাসুলের বাণী পৌঁছানোর বড় মাধ্যম এবং আল্লাহ ও তার রাসুল, মুসলিমদের শাসক এবং মুসলিম জনগণের কল্যাণ কামনার স্থান। অনুরূপভাবে আবশ্যকীয় উপকারী জ্ঞানার্জন এবং রাসুল (সা.) ও সলফে সালেহিনের পদ্ধতিগত কৌশলের ওপর সৎআমলের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেওয়ার সবচেয়ে বড় মাধ্যম।
ইসলামি দাওয়াত শুধু মিম্বারের আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ফলে এখানেই তার শেষ ও সমাপ্তি নয়। বরং সেটি এমন একটি বার্তা যা একজন মুসলিমের আমল, আকিদা এবং চরিত্রগতসহ সামগ্রিক জীবনে প্রতিভাত হয়। হজরত সাদ বিন হিশাম বিন আমের (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হজরত আয়েশা (রা.)-এর কাছে গমন করে বললাম; হে উম্মুল মুমিনিন! আপনি আমাকে রাসুল (সা.)-এর চরিত্র সম্পর্কে সংবাদ দিন। তিনি বললেন, ‘রাসুল (সা.)-এর চরিত্র ছিল কোরআন।’
সত্যভাষী ব্যক্তি তরবারিকে কোষমুক্ত করার মতো যখন তার জবানকে উন্মুক্ত করে, তখন বাগ্মিতা রুহ, আকিদা ও ইমানের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে যায়। তার শব্দমালা অন্তর ও রুহকে উদ্ভাসিত করে প্রভাতের সূর্যের মতো, তার উত্তাপ হৃদয়ে প্রজ্বলিত হয় ঘনজঙ্গলে আগুন জ্বলে ওঠার মতো। আর যখন শব্দমালা রুহবিহীন নিষ্ফল ও নি®প্রভভাবে বক্তার মুখ থেকে নির্গত হয়, তখন সে শব্দমালা জীবনীশক্তিহীন এবং শীতল হিসেবে নির্গত হয়। নিশ্চয় বক্তার রুহ দ্বারা তার বক্তৃতা ও বর্ণনা রঞ্জিত হয়- যেমন ফুল তার রং, বসন্ত তার ফল এবং পানপাত্র তার পানীয়ের মাধ্যমে রঙিন হয়ে ওঠে। শুধু অলংকারযুক্ত শব্দমালা হৃদয়ে নাড়া দেয় না, সাজানো বক্তব্য অন্তরকে আলোকিত করে না- যদি তার মধ্যে সত্যের আলো না থাকে।
বর্তমান দুনিয়ায় প্রভাব বিস্তারের মঞ্চে বক্তব্যের নানা বিপদ ও প্রতিক্রিয়া রয়েছে। বিশেষ করে যাদের কথা শ্রবণশক্তিকে আন্দোলিত করে, হৃদয়কে প্রশান্ত করে এবং যাকে আল্লাহতায়ালা শ্রোতাকে বুঝানোর সুন্দর ক্ষমতা ও বান্দাদের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা প্রদান করেছেন। কেননা এটা বহনকারীর জন্য বড় আমানত এবং বক্তব্য প্রদানকারীর জন্য বিশাল দায়বদ্ধতা, যা বক্তাকে তার বক্তব্য সঠিক মানদ-ে ও যথার্থভাবে সুশোভিত করতে আবশ্যক করে। কখনো তা প্রত্যুষের মেঘমালার মতো উপকারী, আবার কখনো তা লক্ষ্যভ্রষ্ট তীরের মতো হয়। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসুলের প্রতি ইমান রাখে, সে যেন উত্তম কথা বলে নতুবা চুপ থাকে।’ -সহিহ বোখারি ও মুসলিম
কাজেই হে বক্তারা! আপনাদের বক্তব্যকে শিষ্টাচারের চাদরে আবৃত করুন, আর তা হচ্ছে- সত্যবাদিতা। আপনারা বক্তব্যে নসিহা ও সত্য প্রচারের প্রচেষ্টা করুন, যেমনটি রাসুল (সা.) করতেন।
হে মুমিনরা! আপনারা কথার হক সম্পর্কে জানুন এবং স্থান, কাল ও পাত্রভেদে তার মর্যাদা রক্ষা করুন, উত্তম বাক্য দ্বারা উপদেশ দিন, শ্রেষ্ঠ কথামালা দ্বারা সুবাসিত করুন। এ বিষয়ে রাসুল (সা.)-এর এ উক্তিটিই যথেষ্ট, ‘উত্তম বাণী সদকা সমতুল্য।’ -সহিহ বোখারি ও মুসলিম
হে সুযোগ্য খতিবরা! বক্তব্যে স্থান, শ্রোতাদের অবস্থা ও প্রসঙ্গ অনুধাবন করুন এবং সেটাকে অর্থবহ, উত্তম বাক্য ও মানানসই শব্দ প্রয়োগে সজ্জিত করুন। যাতে শ্রবণশক্তির আগেই অন্তরসমূহ এর প্রতি আকৃষ্ট হয়, কেননা অন্তরসমূহ অনুরাগী হয় যেমন শ্রবণশক্তিও অনুরাগী হয়। আর এদিকেই আমাদের মহান রব ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘আর তারা এ উদ্দেশ্যে প্ররোচিত করে যে, যারা পরকালে বিশ্বাস করে না তাদের মন যেন সে চমকপ্রদ কথার প্রতি অনুরাগী হয় এবং তাতে যেন তারা পরিতুষ্ট হয়, আর তারা যা করে তাতে যেন তারাও লিপ্ত হতে পারে।’ -সুরা আল আনআম : ১১৩
২৩ ডিসেম্বর শুক্রবার, মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবা। অনুবাদ মুহাম্মদ আতিকুর রহমান
ভয়েস/আআ